রবিবার, ১৯ মে ২০২৪, ১২:১৯ পূর্বাহ্ন

দিশাহারা চাকরিপ্রার্থীরা

দিশাহারা চাকরিপ্রার্থীরা

স্বদেশ ডেস্ক:

দেশে সরকারি-বেসরকারি উভয় খাতেই কর্মসংস্থানের সংকট দীর্ঘদিনের। প্রতিবছর লাখ লাখ শিক্ষিত তরুণ-তরুণী উচ্চশিক্ষা শেষে চাকরি খোঁজার তালিকায় নাম লেখাচ্ছেন। শিক্ষিত কিংবা অর্ধশিক্ষিতদের জন্য চাকরির বিকল্প হিসেবে উদ্যোক্ত হওয়ার যে আহ্বান সরকারের পাশাপাশি বিভিন্ন মহল থেকে জানানো হচ্ছিল, তাতেও সাড়া দেন না যুবারা। চাকরির পেছনেই অবিরাম ছুটছেন। ফলে বেকারের তালিকা দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হচ্ছে। এমন পরিস্থিতিতে এবার যোগ হয়েছে মহামারী করোনা। মহামারীর কারণে চাকরির বাজার সংকুচিত হয়ে পড়েছে। সঙ্গত বাস্তবতায় চাকরিপ্রত্যাশীদের হতাশা আরও বেড়েছে। এ অবস্থায় চাকরির পেছনে না ছুটে কৃষি খাতে মনোযোগ কিংবা উদ্যোক্তা হওয়ার পরামর্শ দিচ্ছেন বিশেষজ্ঞরা।

জব পোর্টালগুলোতে এপ্রিল মাসের একটি হিসাব দিয়ে এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি) জানিয়েছে, বাংলাদেশে নিয়োগ বিজ্ঞপ্তির পরিমাণ আগের বছরের একই মাসের তুলনায় ৮৭ শতাংশ কমেছে। তার আগে মার্চ মাসে নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি এসেছে গত বছরের মার্চ মাসের চেয়ে ৩৫ শতাংশ কম। গত ২৯ মে ‘কোভিড-১৯ ইমপ্যাক্ট অন জব পোস্টিংস : রিয়েল টাইম অ্যাসেসমেন্ট ইউজিং বাংলাদেশ অ্যান্ড শ্রীলংকা অনলাইন জব পোর্টালস’ শীর্ষক প্রতিবেদনে এ তথ্য প্রকাশ করে ঋণদাতা সংস্থাটি। স্বাস্থ্য খাতে চাকরি কমেছে ৮১ শতাংশ। তথ্যপ্রযুক্তিতে চাকরির বিজ্ঞাপন কমেছে ৮২ শতাংশ। বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থায় চাকরির বিজ্ঞাপন কমেছে ৬৪ শতাংশ। আর আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা (আইএলও) বলছে, করোনা ভাইরাস সংকটে বাংলাদেশে প্রতি ৬ যুবকের ১ জন কর্মহীন হয়ে পড়েছে।

প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশের চারভাগের একভাগের বেশি (২৭.৩৯ শতাংশ) যুবক বেকার রয়েছে। ফেব্রুয়ারি মাস থেকেই বেকারত্ব বাড়ছে। মহামারীর প্রভাবে যুবকদের প্রতি ৬ জনে

একজন কর্মহীন হয়ে পড়েছে। বিশ্বে প্রায় ২৭ কোটি যুবক এ মহামারীতে কর্মহীন হয়ে পড়েছে বলেও তথ্য প্রকাশ করেছে আইএলও। বিশ^ সংস্থাগুলোর এমন তথ্যে দেশের চাকরিপ্রত্যাশী যুবারা আরও বেশি হতাশায় ভুগছেন।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এমন পরিস্থিতিতে শিক্ষিত তরুণ-তরুণীরা চাকরির আশায় না ঘুরে ক্ষুদ্রঋণের সুযোগ নিয়ে মাছ চাষ, হাঁস-মুরগি পালন কিংবা দুগ্ধ খামার গড়ে তুলতে পারে। এ ছাড়া বাংলাদেশে পোশাক খাতের পরই কৃষি সবচেয়ে বড় খাত। তারা কৃষিতেও মনোযোগ দিতে পারে। এতে দেশের কৃষি উৎপাদন বাড়বে হু হু করে। তবে তাদের জন্য সরকারকে বিনা শর্তে পর্যাপ্ত ঋণের সুবিধা নিশ্চিত করতে হবে।

জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের হিসাব অনুযায়ী, বর্তমানে সরকারি চাকরিতে শূন্যপদের সংখ্যা চার লাখেরও বেশি। গত ৫ মাস ধরে সব ধরনের নিয়োগ প্রক্রিয়া বন্ধ থাকায় এ সংখ্যা আরও বেড়েছে। অবশ্য গেল পাঁচ মাসে কতজন অবসরে গিয়েছেন এবং কতটি পদ শূন্য হয়েছে তার হিসাব দিতে পারেনি জনপ্রশসান মন্ত্রণালয়।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, প্রায় দেড় হাজার লোকের নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি প্রকাশের দেড় বছর পেরিয়ে গেলেও এখনো নিয়োগ শেষ করতে পারেনি খাদ্য অধিদপ্তর। অনিয়মের অভিযোগ উঠায় সমাজসেবা অধিদপ্তরেও প্রায় হাজারখানেক লোকের নিয়োগ আটকে আছে। এ ছাড়া ৪১তম বিসিএসের প্রিলিমিনারি পরীক্ষা চলতি বছরের এপ্রিলে হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু করোনার কারণে তা আর হয়নি। ঝুলে আছে ৪০তম বিসিএসের লিখিত এবং ৩৮তম বিসিএসের চূড়ান্ত ফল। এ ছাড়া মন্ত্রণালয় ও বিভাগের জন্য নন-ক্যাডারের নিয়োগগুলোও দীর্ঘদিন ধরে হচ্ছে না। কোভিড পরিস্থিতি যদি অচিরেই নিয়ন্ত্রণে না আসে সে ক্ষেত্রে এসব নিয়োগ প্রক্রিয়া আরও দীর্ঘ হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। কর্মসংস্থানের একটি বড় খাত ব্যাংকিং। করোনার কারণে বেসরকারি ব্যাংকগুলো কর্মীদের বেতন কমাচ্ছে বলে গণমাধ্যমে খবর বেরিয়েছে। পরিস্থিতি স্বাভাবিক না হওয়া পর্যন্ত তারা নতুন করে নিয়োগ দেবে বলেও মনে হচ্ছে না। বেসরকারি অন্য প্রতিষ্ঠানগুলোও ব্যয় কমাতে গিয়ে কর্মী ছাঁটাই অব্যাহত রেখেছে।

এ প্রসঙ্গে বিসিএস ক্যাডার ও নন-ক্যাডার পদে নিয়োগকারী প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ পাবলিক সার্ভিস কমিশনের (বিপিএসসি) চেয়ারম্যান ড. মোহাম্মদ সাদিক আমাদের সময়কে বলেন, আমরা ৪১তম বিসিএসের প্রশ্নপত্র তৈরি করছি। ৪০তম বিসিএসের খাতা দেখা চলছে। ফল প্রস্তুত হচ্ছে। তবে নন-ক্যাডার পদের কয়েকটি নিয়োগ পরীক্ষার সময়সূচি ঠিক করার পরও কোভিডের কারণে স্থগিত করতে হয়েছে। পিএসসির কার্যক্রম বন্ধ নেই। ঈদের পরই নন-ক্যাডার পদে পরীক্ষা নেওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছি।

কীভাবে কোভিড পরিস্থিতিতেও নিয়োগ প্রক্রিয়া চলমান রাখা যায় এমন প্রশ্নে পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর আমাদের সময়কে বলেন, যেভাবে সামাজিক দূরত্ব বজায় রেখে অফিস আদালত চালু রেখেছি, ঠিক সেভাবেই দূরত্ব রক্ষা করে নিয়োগ পরীক্ষাগুলো অব্যাহত রাখা সম্ভব। এতে খুব বেশি সমস্যার সৃষ্টি হবে না। তিনি বলেন, শুধু বাংলাদেশেই নয়, পুরো পৃথিবীতেই এখন কর্মসংস্থানের সংকট তৈরি হয়েছে। সারা পৃথিবীতেই লোকজন চাকরি হারাচ্ছেন। বাংলাদেশে আগেও চাকরির সংকট ছিল। কোভিডের কারণে সে সংকট আরও বেড়েছে। ফলে শিক্ষিত তরুণ-তরুণীদের চাকরির পেছনের না ছুটে বিকল্প পেশা খুঁজতে হবে। বাংলাদেশ কৃষিপ্রধান দেশ। তারা যদি কৃষিতে মনোযোগ দেয়, তা হলে আমাদের কৃষি খাত বড় সাফল্য পাবে। তরুণদের কর্মসংস্থানও হবে। কিন্তু আমাদের তরুণ-তরুণীদের মানসিকতা সেভাবে গড়ে উঠেনি। তারা অফিস-আদালতের চাকরিতেই বেশি মনোযোগী। হাতে মাটি লাগবে এমন কাজ করতে তারা অনাগ্রহী। এ মানসিকতার পরিবর্তন খুবই জরুরি, তা হলে অনেক সমস্যারই সহজ সমাধান হবে।

আহসান এইচ মনসুর আরও বলেন, কোভিড পরিস্থিতি ঠিক হলেও সহজে নতুন চাকরিপ্রত্যাশীদের চাকরি হবে না। কারণ যেসব বেসরকারি প্রতিষ্ঠান এখন তাদের কর্মী ছাঁটাই করছে, সেসব প্রতিষ্ঠান ঘুরে দাঁড়ালে তারা তাদের পুরনো কর্মীদেরই পুনরায় নিয়োগ দেবে। ফলে নতুনদের জন্য কর্মসংস্থানের বিষয়টি বেশ চ্যালেঞ্জিং হয়ে দাঁড়াবে। যুবকরা হাঁস-মুরগি ও দুগ্ধ খামার, মাছচাষ ইত্যাদি করে সহজেই নিজেদের বেকারত্ব ঘোচাতে পারে বলেও মনে করেন বিশিষ্ট এ অর্থনীতিবিদ।

আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার (আইএলও) কনসালট্যান্ট ও জনপ্রশাসন বিশেষজ্ঞ মোহাম্মদ ফিরোজ মিয়া আমাদের সময়কে বলেন, স্বাস্থ্যবিধি রক্ষা করে চাকরির নিয়োগ পরীক্ষাগুলো নেওয়া যেতে পারে। চাকরিপ্রার্থীরা সবাই উচ্চশিক্ষিত। সুতরাং তারা স্বাস্থ্যবিধি মেনেই পরীক্ষায় অংশ নিতে পারবে। তিনি প্রশ্ন রেখে বলেন, কোভিড পরিস্থিতি যদি আরও দু-তিন বছর অব্যাহত থাকে তা হলেও নিয়োগও বন্ধ থাকবে? এটি তো অসম্ভব। তিনি আরও বলেন, বাংলাদেশে সাধারণ শিক্ষিতদের জন্য চাকরির বাজার আগে থেকে সংকুচিত। আমাদের এখানে কারিগরি জ্ঞানসম্পন্ন লোকের প্রচুর অভাব। এ জন্য কোভিডসহ যে কোনো কঠিন পরিস্থিতি মোকাবিলার জন্য কারিগরি শিক্ষার দিকে মনোযোগ দিতেই হবে।

আইএলওর কনসালট্যান্ট ফিরোজ মিয়া বলেন, শিক্ষিত তরুণ-তরুণীদেও চাকরির বিকল্প চিন্তা করারও সময় এসেছে। তারা তাদের পরিবারিক কৃষিতেও যোগদান করে কৃষি উৎপাদন বাড়াতে পারে। তবে এসব কাজের জন্য তরুণ-তরুণীদের প্রশিক্ষণ দিতে হবে। কৃষিই দেশকে বাঁচিয়ে রাখছে। সুতরাং শিক্ষিতরা চাকরির জন্য দীর্ঘ সময় বসে না থেকে সেদিকে ক্যারিয়ার করতে পারে।

দয়া করে নিউজটি শেয়ার করুন..

© All rights reserved © 2019 shawdeshnews.Com
Design & Developed BY ThemesBazar.Com
themebashawdesh4547877